বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০২ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পাপের বোঝার ভার যে দুঃসহ!

অজয় দাশগুপ্ত:
একুশে আগস্টের রাজনৈতিক পরিণতি কী এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল এক আলোচনায়। কী চেয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হোতারা? বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য জনসমাবেশে একের পর ভয়ংকর ধ্বংস ক্ষমতার গ্রেনেড হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট সভাপতি শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে প্রাণে মেরে ফেলা। উদ্দেশ্য স্পষ্ট ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার চারজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যার পর শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে যে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তাদের একযোগে নির্মূল করা। এ নেতৃত্ব যে প্রচন্ড ক্ষমতা রাখে, সেটা স্পষ্ট হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী করিয়েছিলেন বিএনপিকে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত দুই খুনিকেও তিনি সংসদ সদস্যপদ পাইয়ে দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তার ‘নতুন আওয়ামী লীগকে’ নিয়ে রুখে দাঁড়ান। তিনি তখন সংসদ সদস্য পদে নেই। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতাও নেই। কিন্তু তার আহ্বানে সচিবালয়ের সচিব থেকে পিওন-দারোয়ান পর্যন্ত সবাই রাজপথে নেমে এসে জনতার মঞ্চের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে। অসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অচল হয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ১৫ জুলাই শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এটাই ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র নজির। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমানের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ (এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এস সাইদ) শপথ লঙ্ঘন করে। তাদের আচরণ ছিল দারুণভাবে পক্ষপাতমূলক। নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটকে জয়ী করানোর ব্লু-প্রিন্ট বাস্তবায়নে এ সরকার সহায়ক ভূমিকা নেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সংসদে মাত্র ৬০টির মতো আসন নিয়েও সংসদ ও রাজপথের আন্দোলন সমন্বিতভাবে পরিচালনা করতে পারেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্ব বুঝতে পারে সামনে বিপদ আসছে। শেখ হাসিনাকে মোকাবিলার জন্য তারা ২১ আগস্ট ‘মহাপ্রলয়’ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য একটি কোয়ালিশনও গড়ে তোলে।

২১ আগস্টের ‘মহাপ্রলয়’ ঘটানোর জন্য ঘোট পাকিয়েছিল কারা? বিবিসির সাংবাদিক আকবর হোসেন ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর জানিয়েছেন, আদালত ‘ঝঃধঃব-নধপশবফ পৎরসব’-এর ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার জন্য যাদের চিহ্নিত করেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ২১ আগস্টের ঘটনার সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি এবং পরে এ বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, সাবেক সেনা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই তাজুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য ও ১৯৭১ সালে কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে নৌবাহিনীর সাবেক অফিসার লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশ বাহিনীর প্রধান শহুদুল হক, গ্রেনেড হামলার সময় ঢাকার পুলিশ প্রধান আশরাফুল হুদাসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি।

কেমন কোয়ালিশন গড়ে তুলেছিলেন তারেক রহমান, বুঝতে সমস্যা হয় না। এদের কেউ কেউ পরিকল্পনায় ছিলেন, কেউ কেউ দায়িত্ব নেন এক্সিকিউশনের। ঘাতকদের নিরাপদ রাখার ভার বর্তায় একটি অংশের ওপর। গ্রেনেড হামলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সমাবেশে। এ ঘটনা নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে থাকা জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান পরে লিখেছিলেন, সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন এবং কমান্ডে ছিলেন এমন ব্যক্তিরা যুক্ত না থাকলে এ ধরনের ‘বড় পরিসরের সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

ঘাতকদের কোয়ালিশনের মূল তিনটি রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হরকাতুল জেহাদ। এই কোয়ালিশন আওয়ামী লীগকে সুসংহত করায় শেখ হাসিনার সাফল্যে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, সন্দেহ নেই। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনায় সচেষ্ট হন। বঙ্গবন্ধু খুনিরা দম্ভভরে বলেছিল ‘আমরা মুজিবকে হত্যা করেছি। সাহস থাকলে কেউ বিচার করুক।’ ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থাইল্যান্ডের ‘ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড’ লিখেছিল, ব্যাংকক পৌঁছে ফারুক রিহমান জানান এখানে পৌঁছার পরপরই তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান দূতাবাসে তাদের উপস্থিতির খবর জানিয়ে দিয়েছেন। ওই দুটি দেশে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।

৭ নভেম্বর ‘ব্যাংকক পোস্ট’ লিখেছে, জনৈক মার্কিন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফারুক আজ (৬ নভেম্বর) মার্কিন কনস্যুলেটে আসেন এবং তার ও আরও ১৬ জন অফিসারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুটির জোর খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না!

কিন্তু ২১ আগস্টের ভয়ংকর পাপ বিএনপি ও তাদের কোয়ালিশনের জন্য কাক্সিক্ষত ফল এনে দিতে পারেনি। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার অপচেষ্টা হয়েছে, কিন্তু জাতীয় সংসদে তা নিয়ে আলোচনা করতে দেওয়া হয়নি। প্রথম আলো পত্রিকা ২৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিল ‘হরতালে অফিস না করলে বেতন কাটা’। গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে হরতাল পালনের ডাকে যারা সাড়া দিয়েছিল, তাদের এভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। আর ১৪ সেপ্টেম্বর (২০০৪) আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বিরোধীদলীয় নেতার প্রাণনাশের চেষ্টা নিয়ে সংসদে আলোচনা নেই’।

খালেদা জিয়া এতেও দমে যাননি। তিনি সংবিধান সংশোধন করেন এমনভাবে, যেন বিএনপির সাবেক নেতা বিচারপতি কে এম হাসান ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বসানো হয় বিচারপতি এম এ আজিজকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয় নির্বাচনকে সামনে রেখে। কিন্তু আবারও শেখ হাসিনা রাজপথের আন্দোলনে সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তিনি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে নিয়োগ না দেওয়ার দাবিতে ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। তখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায়। সর্বত্র দাপট হাওয়া ভবনের। কিন্তু বিচারপতি কে এম হাসানকে ‘ক্ষমতায়’ বসানোর চক্রান্ত সফল হয়নি। রাষ্ট্রপতি (বিএনপির নেতা) অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ নিজেকে একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। ৯ নভেম্বর তিনি সচিবালয়ে বলেন ‘আমার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার। আমার পছন্দ অনুযায়ী আমি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেব।’ [প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর]

এখানেই খালেদা জিয়া থেমে থাকেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) জানায়, বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ১ কোটি ২২ লাখ ভুয়া নাম ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছে। [ডেইলি স্টার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৬]

অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের ‘রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার’ উপদেষ্টাদের না জানিয়েই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। [সমকাল, ২৮ নভেম্বর ২০০৬]

রাজপথের আন্দোলন দমনে নামানো হয় সেনাবাহিনী। [প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০০৬]

আন্দোলন মোকাবিলায় বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। [সমকাল, ৬ জানুয়ারি, ২০০৬]

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির ১৭ নেতা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। [জনকণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি ২০০৭]

কিন্তু শেখ হাসিনা দমে যাননি। তিনি মহাজোটের নেতৃত্ব দেন সফলভাবে। রাজপথের আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারি করেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। তারেক রহমান ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘আর রাজনীতি করব না’ মুচলেকা দিয়ে লন্ডন পাড়ি জমান। প্রচন্ড দাপুটে ‘হাওয়া ভবনে’ তালা পড়ে। সেই থেকে ১৫ বছর তিনি ‘নির্বাসিত’। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা ফের প্রধানমন্ত্রী। পরের দুটি নির্বাচনেও তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও জোটসঙ্গীরা জয়ী হয়।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ‘State-backed crime’ সংঘটিত করেছিল। তখন তারা ক্ষমতায় ছিল। তারা এভাবে শেখ হাসিনাকে প্রাণে মারতে এবং রাজনৈতিকভাবে জয়ী হতে চেয়েছিল। কিন্তু এ ভয়ংকর অপরাধের জেরে তারা চলে গেছে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে এবং তা চলছে ২০০৬ থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ বছর। তারা ফের রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট ফের ‘State-backed crime’ সংঘটিত করা। কিন্তু ২১ আগস্টের পাপের বোঝার ভার যে দুঃসহ ও অসহনীয়!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION